যদি কখনও বিশ্ব হকির ইতিহাস লেখা হয়, তাহলে প্রথম সারির নামগুলোর মধ্যে থাকবেন এক মহান ভারতীয় – মেজর ধ্যানচাঁদ সিং। তাঁকে বলা হয় “হকি জাদুকর”। তাঁর খেলার জাদুতে শুধু ভারত নয়, গোটা বিশ্বই ছিল মুগ্ধ।
জন্ম ও শৈশব
ধানচাঁদের জন্ম ১৯০৫ সালের ২৯ আগস্ট, উত্তর প্রদেশের আলাহাবাদে। ছোটবেলায় তিনি হকিতে খুব একটা মন দিতেন না। খেলাধুলার থেকে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার স্বপ্নই ছিল তাঁর। তবে ভাগ্য তাঁকে নিয়ে গেল ভিন্ন পথে। সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পরই হকির সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়।
তাঁর ডাকনাম “চাঁদ” তিনি পেয়েছিলেন কারণ তিনি প্রায়শই রাতে চাঁদের আলোয় প্র্যাকটিস করতেন। খেলাধুলার প্রতি এতটাই আবেগ ছিল যে দিনে দায়িত্ব পালন করার পর রাতে খেলার অনুশীলন করতেন।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সূচনা
১৯২৬ সালে নিউ জিল্যান্ড সফরের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক হকি মঞ্চে প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন ধ্যানচাঁদ। সেই সফরেই তাঁর খেলোয়াড়ি প্রতিভা বিশ্ববাসীর নজর কাড়ে। এরপর তিনি ১৯২৮, ১৯৩২ এবং ১৯৩৬ সালের অলিম্পিকে ভারতকে সোনা এনে দেন।
বিশেষ করে ১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিকে তাঁর খেলা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন হতো। হিটলারের চোখের সামনে ভারত জার্মানিকে ৮-১ গোলে হারায়, আর ধ্যানচাঁদ একাই করেন তিনটি গোল। হিটলার এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি নাকি ধ্যানচাঁদকে জার্মান সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন।
খেলার জাদু
ধানচাঁদের খেলার ধরণ ছিল অবিশ্বাস্য। তাঁর স্টিক কন্ট্রোল এতটাই নিখুঁত ছিল যে অনেক সময় মনে হতো বলটি স্টিকের সঙ্গে আটকে গেছে। তাঁর ড্রিবলিং, পাস এবং গোল করার ক্ষমতা এমন ছিল যে প্রতিপক্ষ প্রায় অসহায় হয়ে যেত।
একবার নেদারল্যান্ডসে খেলার সময় তাঁর স্টিক পরীক্ষা করে দেখা হয়েছিল সেটাতে কোনো চুম্বক আছে কি না! কারণ দর্শকদের কাছে তাঁর খেলা একেবারেই অলৌকিক মনে হতো।
অর্জন ও সম্মান
- ১৯২৮, ১৯৩২ ও ১৯৩৬ – টানা তিনটি অলিম্পিকে সোনা জয় 🏅
- ভারতীয় সেনাবাহিনীতে সেবা দেওয়ার জন্য তিনি মেজর পদে উন্নীত হন।
- ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত করে।
- তাঁর জন্মদিন ২৯ আগস্ট আজও ভারতে জাতীয় ক্রীড়া দিবস হিসেবে পালিত হয়।
মানুষ ধ্যানচাঁদ
খেলার বাইরে ধ্যানচাঁদ ছিলেন বিনয়ী, সাদাসিধে একজন মানুষ। খ্যাতি কখনও তাঁকে বদলাতে পারেনি। সবসময় দেশের জন্য খেলাকে তিনি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়—আসল ক্রীড়াবিদ কখনও শুধু জয়ের জন্য খেলে না, খেলে খেলাটির প্রতি ভালোবাসা ও দেশের প্রতি দায়িত্ব থেকে।
কেন ধ্যানচাঁদ অনুপ্রেরণা?
ধানচাঁদ দেখিয়েছেন—অভ্যাস, শৃঙ্খলা আর আত্মবিশ্বাস থাকলে সব অসম্ভব সম্ভব হয়ে যায়। তিনি শুধু এক মহান হকি খেলোয়াড়ই নন, বরং ভারতের ক্রীড়া ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। আজকের প্রজন্ম যদি তাঁর জীবনী পড়ে, তাহলে বুঝতে পারবে সত্যিকারের দেশপ্রেম আর ক্রীড়া-নিষ্ঠা কীভাবে এক মানুষকে অমর করে তুলতে পারে।

উপসংহার
ধানচাঁদ ছিলেন হকির জাদুকর, যিনি খেলার মাঠে জাদু দেখিয়েছিলেন। তাঁর নাম আজও কোটি কোটি ক্রীড়াপ্রেমীর হৃদয়ে বেঁচে আছে। তিনি ভারতের গর্ব, এবং বিশ্ব হকির ইতিহাসে এক অমলিন অধ্যায়।